Sunday, August 30, 2009

ধর্মাচরণ ও বাঙ্‌লাদেশ – ২

দেড়প্রস্থ খাওয়া শেষে যেই না একটু আরাম করে বসেছি সোফায়, আবার পরে গেলাম ব্যারিষ্টার সাহেবের সামনে। আসলে উনিই চলে এলেন, কি যেন খুঁজছিলেন, এবার আমিই যেচে তাকে বসতে বললাম পাশে। আশ-পাশের উৎসুক দু’এক জনের কানের রেডার লক্ষ্যস্থির করেছে আমাদের মৃদু আলাপচারিতায়। ফিরে যাই ওনার প্রথম প্রশ্নে – বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান, তারা যদি চান তো সরকারের বাধা কোথায় ইসলামী আইন-কানুন প্রচলন করতে? আমিও তাই বলি, সমস্যা তো কোথাও নেই। কিন্তু ঐ যে, একটা বিরাট যদি আছে এই প্রশ্নে। মানুষের চাইতে হবে, হিযবুত তাহিরীর বা হরকাতুল মুজাহিদীন চাইলে হবে না। মানুষকেই চাইতে হবে। এই যে শতকরা ৮০’র ওপর মানুষ মুসলমান, তারা কি চায়? চুরি করলে কব্জি কেটে দেয়া হোক? নাকি স্বামীর সাথে তালাক হলে স্ত্রীকে আরেক পুরুষের সাথে সহবাস-সমেত বিয়ে ও তালাক পূর্বক আগের স্বামীর সাথে আবার বিয়ে হোক? ইসলামী কানুনের নামে উন্মত্ত রাজতন্ত্র চালু হোক? ধর্মের লেবাস পরে মানুষ দেড় হাজার বছর আগের যুগে ফিরে যাক? না মানুষ তা চায় না। পরিষ্কারভাবেই মানুষ তা চায় না, এবং এই মানুষ লঘুভাগের ২০ শতাংশ মানুষ না, ঐ ৮০ শতাংশই। মানুষ ইসলামী-হিন্দু-খ্রীষ্ট কোন ধর্মীয় আইনই চায়না বলেই বাংলাদেশে ধর্মীয় আইন নেই। এতক্ষনে আবার কথা বলে উঠলেন ব্যারিস্টার সাহেব, “কেন? মুসলিম বিবাহ আইন? উত্তরাধিকার আইন?” হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, ঐ আইনসমূহের অস্তিত্ব আছে সত্যি, কিন্তু ওগুলো তো সার্বজনীন আইন নয়। কখনো শুনেছেন, হিন্দু ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুসলিম আইনে? সুতরাং এই উপআইন, পাতিআইন এসব আসলে মূল্যহীন। বাংলাদেশে এখনো মানুষ সত্যিকারের শিক্ষিত হয়নি তাই, এইসব আইন এখনো টিকে আছে। দেনমোহরের মত অপমানকর ব্যবস্থা এদেশে এখনো দাপট নিয়ে চলেছে। তাই যখন দেখি নারী দিবসে কোন প্রমিন্যান্ট নারীবাদী নারীর হাতে নারীমুক্তির প্ল্যাকার্ড, মনে মনে বুঝতে চেষ্টা করি ইনি স্বামীর পকেট থেকে কত লক্ষ টাকা দেনমোহর হিসেবে হাতিয়েছেন?

আসলে এই প্রসঙ্গে জৈন-ব্রাক্ষন্য-ইসলাম আলাদা করে একেকটা নাম বলার দরকার নেই, সব রসুনের গোড়া একই জায়গায়। বেদ-বাইবেল-কোরান সব জায়াগায়ই এক মতের ছায়া, নারী পুরুষের ভোগ্যা। নারীর আলাদা কোন অনুভূতি নেই, বোধ নেই, মর্যাদা নেই – অস্তিত্বই নেই। এই যে নেই নেই নেই, এর থেকে মানুষের উপায় কি? উপায় আবার কি! উপায়ের জন্য কি মানুষ বসে আছে? হিন্দু বিধবাদের কি এখন বিয়ে হচ্ছে না? সতীত্বের অগ্নি-পরীক্ষা ইদানীং কবে কোথায় শোনা গেছে? হাসিনা-খালেদা-রওশন এরশাদ-বিদিশা এদের কি ইসলাম ছুটে গেছে? গেলে আমরা চুপ কেন? মৌলানারা চুপ কেন? আসলে যুগে যুগে মানুষ দরকার মতই বদলে নিয়েছে এই ধর্ম নামের উপকথাকে। যখন যেভাবে এই গালভরা ব্যবস্থা মানুষের সমসাময়িক পারিপার্শ্বিকের সাথে খাপ খাওয়াতে পেরেছে, তাই টিকে থেকেছে ধর্মের ছাতার তলায়।

তা থাকুক। কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে সামনে। এই সামনে যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার আলোয় ভেসে যাবে একদিন ধর্মাচরণের অপ্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ। যা টিকে থাকবে, তা হবে ঐ যুগের মানুষেরই এ্যাট্রিবিউট, কিংবা বলা যেতে পারে সামগ্রীকভাবে ঐ সমাজেরই ক্রাইটেরিয়া। ধর্মাচরণের মূল উদ্দেশ্য মানুষ শুধমাত্র শিক্ষিত হলেই বুঝতে পারবে – তখনই মানুষ ড. আহমদ শরীফের ভাষায় বলতে পারবে – “আমি জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু-ইহুদী-খ্রীষ্ট-মুসলমান শ্রাস্ত্র মেনে চলি কারণ আমি ঐসব শাস্ত্রে ভর করে মানুষ হতে চাই, কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি হওয়ার জন্য নয়।“ শাস্ত্রটা পথ মাত্র গন্তব্য মানুষ হওয়া। আর একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাই পারে মানুষকে এই গন্তব্য চেনাতে।

No comments:

Post a Comment