Sunday, August 30, 2009

ধর্মাচরণ ও বাঙ্‌লাদেশ – ১

“গনতন্ত্র গনতন্ত্র বলে আপনারা চিৎকার করছেন, তো আসুন গনতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত করি। যে দেশে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান, সেখানের মানুষ চাইলে সরকার ইসলামী কানুন চালু করবে এটাই তো গনতন্ত্র – নাকি?” ঘরভর্তি লোকের সামনে আমার মুখের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ব্যারিস্টার সাহেব। যৌক্তিক কথা বটে! বন্ধুর বাড়ি এসে কে যায় বন্ধু-পত্নীর সই-পতির সাথে বাহাস করতে! কিন্তু ব্যারিস্টার সাহেব নাছোড়বান্দা – অনেকদিন যাবতই তিনি বিরক্ত আমার-আমাদের উপরে, যারা কিনা বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার দাবী করে। আজ সুযোগ বুঝে আমাকে একহাত নেবার তাল করছেন। আমি এড়াতে চাইলেও, তিনি খোচাঁখুঁচি থামাতে রাজী নন। আবার জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা তো চলনে-বলনে ইসলাম মানেন না, নামায-কালাম তফাত করে দিয়েছেন বহু আগেই, কাউকে আল্লাহ-বিল্লা করতে শুনলে মনে করেন বিলাপ করছে! তো কোন যুক্তির বশে ইসলামী নামখানা এখনো বিসর্জন দেননি?”

নাহ! বেচারা আজ ছাড়বেন বনে মনে হয় না, হয় ইসলামের নয় আমার অনৈসলামের খৎনা দিয়েই তবে শান্ত হবেন! তো জিজ্ঞেস করি, “‘ইসলামী নাম’ জিনিসটা কি?” “কেন এই যে প্রশ্ন আহমেদ – এখানে প্রশ্নটা বাদ দিলে, আহমেদ তো ইসলাম থেকেই চুরি করা! নবীজির আরেক নাম আহমেদ।” ঝটপট উত্তর ওনার।

ও আচ্ছা! এই তাহলে ইসলামী নামের শানে নুযুল। আমিতো ভেবেছিলাম বেচারা নামখানাকেই না আবার মুসলমানি দেয়া লাগে। আচ্ছা মুসলমানী ব্যাপারটার রহস্যটা আসলে কি? খৎনা তো খৃষ্টানরাও করে, আবার ইহুদীরাও করে। তো মুসলমানেরা কেন করে? মুসলিম বিশ্বের দিকে একবার তাকান, ইহুদী-খৃষ্টান ছাড়া যেন তাদের আর কোন শত্রু নেই। মুসলমানের মুখে শুধু একই কথা – ঘরে বাইরে ইহুদী-নাসারা-খেরেস্তানের দল মুসলিম জাহানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ওদের মনে হয় আর কোন কাজই নেই, মুসলমানের ক্ষতি করতে পারলেই ওদের হেভেন-আফটার লাইফ নিশ্চিত! ভাবছিলাম, ব্যারিস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করব কিনা, যে ইহুদী বাইবেল বলছে, তাদের প্রোফেট আব্রাহামের বংশধরদেরকে অন্যান্য বিধর্মীদের থেকে আলাদা করে চেনার জন্যই ঈশ্বর এই খৎনার আদেশ দিয়েছিলেন – মুসলমানেরা তাহলে কেন খৎনা করে ইহুদী পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে? নাহ্‌! সারাদিন রোজা রেখে বেচারার সংযমের বারোটা বেজে গেছে, বেয়াড়া প্রশ্ন করে বন্ধুর বাড়ির উৎসবের আমেজ নষ্ট করার ঝুঁকি নেয়া যায় না। তার বদলে জিজ্ঞেস করি, আব্দুল্লাহ নামটা কি ইসলামী নাম? “অবশ্যই, আব্দুল্লাহ মানে আব্‌দ-আল্লাহ্‌ অর্থাৎ আল্লার দাস, Slave of Allah” আবার তড়িৎ উত্তর পেলাম। কথায় বলে স্বভাব কি আর সহজে যায়, আমারও যাচ্ছে না – ফের জিজ্ঞেস করি “আমীনা?” এবার খানিকটা উষ্মাভরা জবাব পেলাম – “এটিও অবশ্যই ইসলামী নাম, মুহাম্মাদ(সঃ) এর মায়ের নাম। আপনারা নাস্তিক নাস্তিক ভাব করেন, যুক্তিবাদের নামে কলমা পড়েন কিন্তু সাধারন জিনিসটাও অবহেলাও শেখেন না।” মুচকি হেসে এবার বলি, নবী মুহাম্মাদের পিতা-মাতা কি মুসলমান ছিলেন? খাদিজা নাম যখন রাখা হয়েছিল, তখন কি তিনি মুসলমান ছিলেন? নাকি পরে নাম বদলেছিলেন? তেমনি সাহাবীরাও কি তাদের নাম বদলে ইসলামী নাম রেখেছিলেন? এত ইসলামী নাম কোথায় পাওয়া যাবে? কোন এনসাইক্লোপিডিয়ায় সংকলিত আছে ইসলামী নাম? তাহলে এই যে আব্দুল্লাহ, আমীনা, আবু তালেব, উসমান, উমর, আলী – এইসব নাম কেমন করে ইসলামী নাম হয়! নিমন্ত্রিতদের অনেকেই হো হো করে হেসে উঠলেন। তাদের থামাতে জলদি আবার কথার খেই ধরি – অর্থাৎ নামের মুসলমানিত্ব-হিন্দুত্ব-বৌদ্ধত্ব বলে আসলে কিছু নেই, তবে ভাষাগত পরিচয় আছে। হাজার হলেও নামওতো শব্দ – আর দশটা শব্দ-পদের মতই বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়া।

দেখুন, কেউ যদি তার মেয়ের নাম রাখে বকুল/শিউলি/টগর/গোলাপী, আমরা গিয়ে প্রশ্ন করি না, এটা ইসলামী নাম না হিন্দু নাম। কেন করি না? নিজের অজান্তই কিন্তু আমরা নামের ধর্মীয় পরিচয় অস্বীকার করি, প্রতিদিনই করি। বড়জোড় বলতে পারি আরবী নাম, ফার্সী নাম, ইংরেজী নাম ইত্যাদি। কিন্তু গায়ের জোরে মানুষের নামের মুসলমানী তকমা দিতে গিয়ে আমরা বঙ্গীয় মুসলমানের আসল দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলি – অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা।

আমাদের বেশিরভাগ মুসলমানই মনে করেন আরবী নাম মানেই ইসলামী নাম। অথচ তারা জানেনই না যে আরবী প্রথমে কাফেরদের ভাষা, তারপর ইহুদী, খ্রীষ্টান এবং সর্বশেষে মুসলমানের ভাষা। সুতরাং আরবীর উপর মুসলমানদের দাবী সবার থেকে কম। কিন্তু ব্যারিষ্টার সাহেবও অনেকের মতই স্বীকার করতে চান না বাঙ্গালী মুসলমান এখনো শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। আফসোস করে বলি, বাংলা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাত্র পাঁচটা বছর আগে ভাগ হতো, তাহলে মেট্রিক পাশ কেরানিও ওপার থেকেই ভাড়া করে আনতে হতো। এখানে বিতর্কের দরকার নেই, এটা ইতিহাস। যারা আজ বাঙ্গালী মুসলমান বলে গর্ব করেন, তারা তাদের বংশের প্রথম বা ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিতীয় পুরুষ যারা ইংরেজী শিখেছেন, শহরে দালানে বাস করেছেন। দেশ ভাগের সময় বাঙ্গালী তো গেরস্থই ছিল। এখন গন্ডায় গন্ডায় শহরে এসে বেশ শিক্ষিত হয়েছেন! টাকা করেছেন, সম্মান কিনেছেন। কিন্তু সলিড ফাউন্ডেশান নেই কারও, তাই এই প্রজন্মের বাঙ্গালী মুসলমান লোভী আর চরিত্রহীন। দেখবেন, শহরে কারো বাসায় মিলাদ হলে দশ জন লোক মেলানো ভার, আর মাউলানা যদি যদি বয়ান শুরু করে, সবারই গলায় ব্যাঙ ঢুকে খাকারি বেরুতে থাকে। অথচ নাম মুসলমান কি হিন্দু তা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই – হোক সে ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার বা আমাদের এই ব্যারিষ্টার সাহেবের মত আইনবিশেষজ্ঞ। এর থেকে সহসা মুক্তি নেই, পরের প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

No comments:

Post a Comment