Tuesday, September 15, 2009

শাহ আব্দুল করিম ও বাউলসম্রাট বিতর্ক

শাহ আব্দুল করিম নিঃসন্দেহে বাংলা লোকসংগীতে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। হাওড়ের জলের ধ্বনি, কাঁদা-মাটির গন্ধ আর মানুষের বিবিধ জীবনাচরণের নানামুখী দার্শনিক উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা চিরায়ত সাহিত্যধারাকে। তাঁর অবদানের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

বাউলধর্ম বাংলা লোকধর্মের বিস্মৃতপ্রায় অবশেষ। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বারে বারে বিদেশি শক্তি এসেছে, সাথে নিয়ে এসেছে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজধর্ম প্রতিষ্ঠায় তারা আক্রমণ করেছে অঙ্গ, বঙ্গ, গৌড়ের লোকায়ত ধর্মবিশ্বাসকে, ফলে তা বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের ধারায় সুস্পস্ট দু’টো বড় ঢেউ লেগেছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল আমলে এবং তারপর শেষটি লেগেছিল মুসলিম শাসনামনে। মাঝখানে হিন্দু শাসনামলে অবশ্য পরিবর্তনের ধারা স্তিমিত হয়েছে বলেই অনেকে মত দেন, কেননা তখন লোকধর্ম ছিল তীব্র আক্রমণের মুখে। ফলে বিকাশের বদলে তা অনেকটা মিইয়ে গেছে।

মুসলিম শাসনামলের শুরুতেই বাউলধর্ম আবার বদলাতে শুরু করে। পারস্যের মুসলিম সূফিদের আগমনে বাংলায় একধরণের পারসিক-আরবী ভাববাদের বিকাশ শুরু হয়। রাজধর্ম ইসলাম হওয়ার পরে তা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বাউলদের মাঝেও এর ছোঁয়া লাগে। বাউল দর্শনে স্থান পায় আল্লাহ-নবী বিশ্বাসের ভেদ নির্ণয়ের আলোচনা। কিন্তু তাতে বাউলের দেহতত্ত্ব বদলায়নি মোটেও, বরং আরও গভীর ও সমৃদ্ধ হয়েছে। পর্তুগীজ ও ইংরেজদের আগমনে বাংলায় খ্রীষ্টধর্মেরও খানিকটা প্রভাব পড়ে, তবে তা বাউলধর্মকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। উপরন্তু বাউলরা খ্রীষ্টদর্শনকে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন একেশ্বরী দর্শনকে খারিজ করতে। লালনের গানে বারে বারে এসেছে ইসলামের সাথে খ্রীষ্ট দর্শনের তুলনা যা তুলে ধরেছে একেশ্বরী দর্শনের সীমাবদ্ধতা।

সংক্ষেপে, বাউলধর্ম বাংলা লোকধর্মের ধ্বংসাবশেষ। বাউলধর্মে পরকালের কোন স্থান নেই। বাউল হতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নিতে হয়; নিগূঢ় দেহতত্ত্বের সাধনায় বাউল তার জীবন ব্যয় করে। দীক্ষা এককভাবে বা সাধনসঙ্গীকে নিয়ে যৌথভাবে নেয়া যায়। সাধনসঙ্গী ব্যাতীত বাউলসাধনা অপূর্ণ থাকে। দীক্ষা শেষে বাউল হন 'জ্যান্তে মরা'। এটি দেহত্ত্বের সাধনার গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি স্তর; বাউল হতে হলে সকলকেই এই স্তর পার হয়ে আসতে হয়। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর আনোয়ারুল করিম বলেন:

A Baul is not born, he is made. If anyone is willing to accept the Baul faith, he or she is inducted into the Baul cult after being properly initiated by the Baul Guru. When a Baul is initiated, a ceremony is arranged for him or her or for the couple who are initiated jointly, by other Bauls. Woman or female plays the most vital part in Baul cult. Without woman partners the cult loses its significance. Woman is also considered a ' chetan guru' or one who is awaken or conscious of all activities in the cult.

Here the persons to be initiated undergo certain process or rituals with the guru that is never disclosed to others. On the following day, the couple is taken to a purifying bath either to a river or in a pond. A 'khilka' is a new white cloth which stands as the symbol of 'kafaon' as used by the Muslims for a burial cloth and is given to the couple who undergo initiation process with this end in view that the persons who are being initiated are also taken as dead to the life which they led previously.

They are now considered dead while still living . In Baul terminology, it is taken as 'jyante-mora'. The initiating couple then taken to the shade of a big 'chadoa' or cover which is held by four persons, of them, two are women taking the four corners of the 'chadoa' or shed while the others who are already initiated help the initiating couple dress in a 'khilka'.The male initiate is then covered with a 'pagree' or turban. Underneath his outer garments the initiate is then made to wear a very tight-fitting underwear or a catche-sexe known as 'dor-kowpin' or 'kapni'.It is a tiny loin cloth worn by the ascetics of India and Bangladesh.


যা-ই হোক, যদিও আকাঙ্খিত নয়, তথাপি একটি বিতর্ক এখানে রয়ে যায় - শাহ আব্দুল করিমকে বাউল বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? যদিও তাঁর গানে দেহতত্ত্ব ব্যপকভাবেই স্থান পেয়েছে, তবুও বাউল দর্শন কতখানি তিনি ধারণ করতেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ৬০ এর দশকে তিনি বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন গণসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের সভার এক পর্যায়ে গণসঙ্গীত পরিবেশনা একসময় কাস্টোমারি ছিল। সে সময়টাতে তিনি প্রচুর গণসঙ্গীত রচনা করেছেন, গেয়েছেন। ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী তাঁকে প্রতিবাদী গণসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি কমুনিষ্ট রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে এসে সাম্যবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছেন, এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে কমরেড বরুন রায়ের কথা বলতে হয়। যদিও করিমতিনি স্পস্ট করেই বলেছেন তিন কমুনিষ্ট নন, অথবা নাস্তিকও নন; তিনি পরকালে বিশ্বাসী। এসময় অসাম্প্রদায়ীক মৌলিক গান রচনা করে তিনি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আত্মনিমগ্ন বাউল সাধক না হয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিবাদের পথ। তাঁর সঙ্গীত জীবনের সাথে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সমাজ সচেতনতা। এমনকি তিনি জনসংখ্যা রোধে সচেতনতামূলক গানও রচনা করেছেন।

হাওড় অঞ্চলের লোকসংগীতের যে ধারা সেটি কি বাউলস্রোতে মিশতে পেরেছে? কিংবা চেয়েছে? সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার গান স্বমহিমাতেই উজ্জ্বল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় হাসন রাজা কিংবা উকিল মুনশীর গানের কথা। এঁদের সকলের গানই বাণী, সুর বিষয় বৈচিত্রে বাংলা লোকসংগীতের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বাউল গান, দর্শনও ধর্মের সাথে তাদের সরাসরি কোন যোগ নেই। সেটি প্রকৃত অর্থেই আরেকটি ধারা। তাই বাউলসম্রাট বিশেষণ দিয়ে শাহ আব্দুল করিমকে মহিমান্বিত করার বিশেষ কোন দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি স্বমহিমাতেই ভাস্বর।

No comments:

Post a Comment